আল্লাহ্ কে কিভাবে চিনবো? — যুক্তিমূলক আলোচনা
আল্লাহ্ কে চিনতে হলে আমাদের প্রথমে বুঝতে হবে, আল্লাহ কোনও দৃশ্যমান বা শারীরিক সত্তা নয়, বরং তিনি পরম, অদ্বিতীয়, একমাত্র স্রষ্টা এবং সমস্ত বিশ্ব ও জীবের মালিক। আল্লাহকে চিনতে হলে, আমাদের উচিত তাঁর সৃষ্টির মধ্যে আল্লাহর নিদর্শন খুঁজে বের করা এবং সেই নিদর্শনগুলির মাধ্যমে তাঁর অস্তিত্ব ও গুণাবলী সম্পর্কে ধারণা লাভ করা।
আমরা যদি আমাদের চারপাশের জগতকে ভালোভাবে লক্ষ্য করি, তাহলে বুঝতে পারব যে এই বিশ্বজগত কোন কিছু থেকেই উদ্ভূত হয়নি। বিজ্ঞান, দর্শন এবং ধর্ম— এই তিনটি ক্ষেত্রেই আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণের জন্য দৃশ্যমান নিদর্শন রয়েছে।
“তারা কি ভেবে দেখেনি, আকাশমণ্ডলী, পৃথিবী এবং তাদের মধ্যে যা কিছু আছে, সবই আমরা সৃষ্টিকর্তার নিকট থেকে সৃষ্টি করেছি? তবে তারা কি কোনো সন্দেহে রয়েছে?”
— সূরা দুখান (৪৪:৩৮)
যতই মানুষ বিজ্ঞানে উন্নতি লাভ করুক না কেন, সৃষ্টির মূল এবং কার্যকারণ সম্পর্কে একদিন আমাদের সবার কাছে আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়। কিছুই ‘নিজে থেকে’ সৃষ্টি হয় না— সব কিছু আল্লাহর সৃষ্টি। পৃথিবী, আকাশ, সূর্য, চাঁদ, জীবন, প্রকৃতি— সবকিছুই তাঁর সৃষ্টির নিদর্শন।
“আমরা কি তাদেরকে পৃথিবী দেখিয়ে দিই যে, এর সৃষ্টির নিয়মগুলি কি তাদের চোখে স্পষ্ট?”
— সূরা আল-আনকাবুত (২৯:৬১)
এই আয়াত থেকে বোঝা যায় যে, আল্লাহ নিজের সৃষ্টির মাধ্যমে তাঁর অস্তিত্ব প্রকাশিত করেন। একমাত্র আল্লাহই এই সুসমঞ্জিত সৃষ্টি এবং তার অটুট নিয়মাবলী পরিচালনা করেন।
"তারা কি আকাশমণ্ডলী এবং পৃথিবীকে দেখে না, যা কিছু আছে তাদের মধ্যে, সব কিছুই আমাদের সৃষ্টি?"
— সূরা আনবিয়া (২১:৩০)
কোরআন বলছে, আমরা সৃষ্টির মধ্যে আল্লাহর নিদর্শন দেখতে পারি। যেমন— প্রকৃতি, সৃষ্টির চমৎকারতা, জীবনের সুষমতা এবং মহাবিশ্বের নিয়মাবলী। যদি আমরা প্রকৃতি, আকাশ, সাগর, পাহাড়, জীববৈচিত্র্য— সব কিছু ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করি, তা থেকে আল্লাহর অস্তিত্ব ও শক্তির প্রমাণ পাওয়া যায়।
ইসলামের দৃষ্টিতে, আল্লাহ সব মানুষের অন্তরে নিজের অস্তিত্বের অনুভূতি সৃষ্টি করেছেন, যা "ফিতরা" নামে পরিচিত। ফিতরা হল মানুষের স্বাভাবিক অভ্যন্তরীণ প্রবণতা, যার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর অস্তিত্বের প্রতি একটি প্রাকৃতিক বিশ্বাস অনুভব করে।
"আমি তাদের অন্তরে তাদের ঈমান সৃষ্টি করেছি।"
— সূরা রুম (৩০:৩০)
মানুষ যখন প্রকৃতির সুন্দরতা ও নিখুঁত সৃষ্টির দিকে মনোযোগ দেয়, তখন তার হৃদয়ে আল্লাহর অস্তিত্বের প্রতি বিশ্বাস শক্তিশালী হয়। এটি এমন এক অনুভূতি যা মানুষের অন্তরে বিদ্যমান, এবং জীবন যাত্রায় তার সঠিক পথকে নির্ধারণ করে।
বিশ্বের সবকিছু নিয়ন্ত্রিত এবং এক সুসমঞ্জিত নিয়মে চলছে। পৃথিবী ঘুরছে, গ্রহ-নক্ষত্রেরা নির্দিষ্ট নিয়মে চলছে, প্রাণীজগৎ এবং উদ্ভিদজগৎ নিজেদের কাজ করছে। সব কিছুই এক নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও নিয়মে চলছে, যা একমাত্র আল্লাহর সৃষ্টি ও পরিচালনায় সম্ভব।
"যিনি আকাশমণ্ডলী এবং পৃথিবীকে সৃষ্টি করেছেন, এবং তার মধ্যে যা কিছু আছে তা সবার ওপর নিখুঁতভাবে নির্ধারণ করেছেন।"
— সূরা আল-জুমার (৩৯:৬)
এ ধরনের বিশাল সৃষ্টির এমন সুনিয়ন্ত্রিত দিকেই আমরা আল্লাহর অস্তিত্ব এবং তাঁর শক্তির প্রমাণ পাই। যদি সৃষ্টির মধ্যে এত সুসংগতি এবং নিখুঁততা থাকে, তাহলে তার পেছনে নিশ্চয়ই এক শক্তিশালী স্রষ্টা রয়েছে।
আমাদের জীবনের অনেক সময় এক অবিচল বিশ্বাস বা আত্মবিশ্বাস অনুভূত হয় যে, আমরা এক অনবদ্য শক্তির ওপর নির্ভরশীল। যখন আমরা বিপদে পড়ি বা সুখ-দুঃখের মুহূর্তে আল্লাহকে স্মরণ করি, তখন এই অনুভূতি আমাদের অন্তরে তাঁর অস্তিত্বের অনুভূতি তৈরি করে।
"হে আল্লাহ, আমাকে ও আমার পরিবারকে সঠিক পথ দেখাও।"
— রাসূল (সঃ) এর দোয়া
আমরা যদি সৎ হৃদয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি এবং তাঁর সাহায্য চাই, তখন আমাদের অন্তরে তাঁর অস্তিত্ব আরও দৃঢ় হয়।
আল্লাহকে চিনতে হলে আমাদের প্রথমে তাঁর সৃষ্টির মধ্যে আল্লাহর নিদর্শনগুলো খুঁজে বের করতে হবে। কোরআন, হাদীস এবং যুক্তির সাহায্যে আমরা তাঁর অস্তিত্ব, শক্তি এবং অনন্ত গুণাবলী সম্পর্কে আরও গভীরভাবে জানতে পারি। মানব অন্তরে আল্লাহর অস্তিত্বের যে অনুভূতি রয়েছে, তা আমাদের একান্তভাবে তাঁর দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। যুক্তি, প্রকৃতি, সৃষ্টির সৌন্দর্য এবং অন্তরীণ অনুভূতি— সব কিছুই আল্লাহকে চিনতে আমাদের সাহায্য করে।