180

বিজ্ঞানের আলোকে স্রষ্টার অস্তিত্ব


বিজ্ঞানের আলোকে স্রষ্টার অস্তিত্ব একটি গভীর এবং বিতর্কিত বিষয়, যা ধর্ম, দর্শন এবং বিজ্ঞান — তিনটি ক্ষেত্রের মধ্যে সম্পর্কিত। বিজ্ঞানের মধ্যে সাধারণত প্রাকৃতিক ও বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়াগুলির মাধ্যমে পৃথিবী ও মহাবিশ্বের বিভিন্ন বিষয় ব্যাখ্যা করা হয়, তবে স্রষ্টার অস্তিত্বের মতো আধ্যাত্মিক বা অতিপ্রাকৃত বিষয়গুলি প্রমাণ বা অস্বীকার করার জন্য বিজ্ঞান প্রথাগতভাবে সরাসরি প্রশ্ন করেনি। তবুও, কিছু বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান এবং তত্ত্বগুলি স্রষ্টার অস্তিত্বের প্রতি কিছু পরোক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমর্থনও প্রদান করতে পারে।

এখানে বিজ্ঞানের আলোকে স্রষ্টার অস্তিত্ব সম্পর্কিত কিছু মূল আলোচনা তুলে ধরা হলো:

বিগ ব্যাং থিওরি (Big Bang Theory) এবং সৃষ্টির শুরু:

বিগ ব্যাং থিওরি হলো বর্তমান মহাবিশ্বের সৃষ্টির ব্যাখ্যা। বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব অনুযায়ী, মহাবিশ্ব প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে একটি বিশাল বিস্ফোরণের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছিল। এই তত্ত্বের প্রাথমিক অবস্থায়, সমস্ত পদার্থ এবং শক্তি এক পয়েন্টে সংকুচিত ছিল এবং বিস্ফোরণের মাধ্যমে এটি বিশাল আকারে বিস্তৃত হয়ে বর্তমানে যে মহাবিশ্ব দেখা যায় তা সৃষ্টি হয়েছে।

  • প্রশ্ন: যদি মহাবিশ্বের সৃষ্টির জন্য কোনো শুরুর পয়েন্ট থাকে, তবে স্রষ্টার একটি হাত বা কিছু অতিপ্রাকৃত শক্তির অস্তিত্বকে অস্বীকার করা কী সম্ভব? বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংয়ের মতে, "আমরা জানি না মহাবিশ্ব কীভাবে শুরু হয়েছিল, কিন্তু সেটি কি কোনো উদ্দেশ্য বা ইচ্ছার মাধ্যমে ঘটেছিল?" এমন প্রশ্নগুলো স্রষ্টার অস্তিত্বের দিকে ইঙ্গিত দেয়।

অন্তর্নিহিত আর্ডার বা শৃঙ্খলা (Fine-Tuning):

বিজ্ঞানী এবং পদার্থবিদরা আজও এই প্রশ্নে বিভক্ত, তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব হলো Fine-Tuning। মহাবিশ্বের অণু, কণিকা এবং শক্তির শক্তিশালী নিয়মগুলির যে নির্দিষ্ট সঠিক সমন্বয় রয়েছে, তা পৃথিবীতে জীবন সৃষ্টির জন্য একেবারে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করেছে। যদি এই শক্তিগুলির মাত্রা সামান্যও পরিবর্তিত হত, তবে জীবন সম্ভব হত না।

  • প্রশ্ন: এই শৃঙ্খলা কি প্রকৃতির অন্ধ নিয়মের ফলস্বরূপ, না কি একটি সুদৃঢ় পরিকল্পনা বা স্রষ্টার ইচ্ছার ফলস্বরূপ?

বিজ্ঞানে এটি "fine-tuning" নামে পরিচিত, যেখানে শৃঙ্খলা এবং নিয়ন্ত্রণ এত নিখুঁত যে এটি একটি সৃষ্টিকর্তার উপস্থিতি নির্দেশ করতে পারে।

দ্য সোর্স অফ কসমিক ল্:

মহাবিশ্বের সমস্ত প্রাকৃতিক নিয়ম, যেমন মহাকর্ষ, বৈদ্যুতিন চুম্বকীয় শক্তি, পারমাণবিক শক্তি, এবং অন্য যেকোনো শক্তি, এই সকল শক্তির সৃষ্টির উদ্দেশ্য কী? বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইন একসময় বলেছিলেন: "ঈশ্বর এমনভাবে একটি শৃঙ্খলা তৈরি করেছেন যা আমরা এখনও পুরোপুরি বুঝতে পারিনি, তবে এটি অদ্বিতীয় এবং চমৎকার।"

  • প্রশ্ন: মহাবিশ্বের শক্তিগুলি কীভাবে এত নিখুঁতভাবে কাজ করছে? এর জন্য কি কোনো শক্তিশালী সত্তার প্রয়োজন, নাকি তা অন্ধ নিয়মে চলে?

জীবনের জটিলতা এবং তথ্য কোডিং:

যতটাই জটিল এবং বিশদভাবে পৃথিবীতে জীবন সৃষ্টি হয়েছে, ততটাই বিজ্ঞান এই জটিলতার ব্যাখ্যা দিতে অক্ষম। ডিএনএ-এর গঠন, জীবনের শর্ত এবং জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় জটিল সংকেতগুলো আসলে পৃথিবীতে অসীম সম্ভাবনা তৈরি করেছে। এটা মনে হয়, মানবজাতি বা জীবের চূড়ান্ত সৃষ্টি কোনো খুঁটিনাটি পরিকল্পনা ছাড়া সম্ভব ছিল না।

  • প্রশ্ন: জীবনের এই অসীম জটিলতা কি তাৎক্ষণিকভাবে স্বাভাবিকভাবে ঘটেছে, না কি এর পেছনে কোনো সুপরিকল্পিত প্রক্রিয়া রয়েছে?

দর্শন এবং সৃষ্টির যুক্তি:

বিজ্ঞানের বহু তত্ত্ব যেমন, অন্তর্নিহিত শৃঙ্খলা, ফাইন-টিউনিং, প্রাকৃতিক নিয়ম এবং জীবনের শুরু আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে কোনো না কোনো স্রষ্টার অস্তিত্ব বা "আল্টিমেট সেজার" থাকতে পারে, যিনি এই শৃঙ্খলা এবং নিয়ন্ত্রণে প্রভাব ফেলেছেন।

  • আল-বিরুনির দর্শন (Cosmological Argument): এখানে বলা হয়, এই বিশ্ব বা মহাবিশ্বে যে কোনো কিছু পরিবর্তিত হচ্ছে, তার জন্য কিছু কারণ থাকতে হবে। এর একটি কারণ বা শুরুর পয়েন্ট (প্রথম কারণ) কেবল একমাত্র স্রষ্টা হতে পারে।

বিজ্ঞানী বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য:

বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী এবং গবেষকরা অনেকেই স্রষ্টার অস্তিত্বের ধারণায় বিশ্বাসী। তাদের মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব হলেন:

  • স্টিফেন হকিং: তিনি বিগ ব্যাং এবং মহাবিশ্বের সূত্র সম্পর্কে গভীর আলোচনা করেছেন, তবে তার পরিসমাপ্তি ছিল এমন যে, "মহাবিশ্ব নিজেই একটি ব্যবস্থা, যা স্রষ্টার সৃষ্টি বা উদ্দেশ্যের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে।"
  • আলবার্ট আইনস্টাইন: তিনি বলেছিলেন, "এই মহাবিশ্বের মধ্যে যে সৃজনশীল শক্তি কাজ করছে তা মহৎ এবং অপরিসীম।"

বিজ্ঞান স্রষ্টার অস্তিত্বের সরাসরি প্রমাণের চেষ্টা করে না, তবে এটি কিছু এমন প্রশ্ন উত্থাপন করে যা স্রষ্টার অস্তিত্বের প্রতি একধরনের ইঙ্গিত দিতে পারে। সৃষ্টির শৃঙ্খলা, মহাবিশ্বের শুরু, জীবনের জটিলতা এবং প্রাকৃতিক নিয়মের নিখুঁত সঙ্গতি এ সবই স্রষ্টার অস্তিত্বের পক্ষ থেকে যুক্তি হিসেবে উপস্থাপিত হতে পারে। বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে স্রষ্টার অস্তিত্বের বিষয়ে বিভিন্ন মত থাকতে পারে, তবে আধ্যাত্মিকভাবে এবং দার্শনিকভাবে এর অনেক দিকের সমর্থন পাওয়া যায়।